মুফতি আবু জোবায়ের
ফ্রান্সের নজিরবিহীন দাঙ্গা-সহিংসতা চলছে। ফ্রান্সের যেকোনো বড় শহরের রাস্তাগুলোকে এখন দেখলে মনে হবে যেন এটি কোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদ। ফ্রেঞ্চ গণমাধ্যমগুলোর দাবি, গত তিন রাতে ২০০০ গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। রিপোর্ট হয়েছে প্রায় ৪ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। আর, বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ৫শ ভবন।
অনেকেই হয়তো ভাবছেন— অনলাইন গেমসের সাথে ফ্রান্সের চলমান ঘটনার সম্পর্ক কী? খোদ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো (৩০ জুন শুক্রবার) জরুরি এক বৈঠক শেষে জানান, বিক্ষোভকারীদের বেশিভাগের বয়স ১৪-১৮ এর মধ্যে। মূলত, নেট দুনিয়ায় তারা যা দেখছে তারই অন্ধ অনুকরণ করছে। বাস্তবতার সাথে তফাৎ বুঝতে পারছে না। ইন্টারনেট গেমসের সহিংস কর্মকাণ্ডকে বাস্তবতা বলে মনে করছে তারা। দেখে মনে হচ্ছে, যেসব ভিডিও গেমস তাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে সেগুলোই তারা রাস্তায় রিক্রিয়েট করার চেষ্টা করছে। এজন্য, কিশোরদের বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হচ্ছে।
কঠিন সত্য হচ্ছে, শিশু-কিশোররা সহিংস সিনেমা বা গেম ইত্যাদির চরিত্রগুলোর সঙ্গে মিশে গিয়ে নিজেরাই সে চরিত্ররূপে আবির্ভূত হয়। গেমের চরিত্রের কর্মকাণ্ড তাদের বাস্তব জীবনে ঘটাতে ইচ্ছা জাগে। অনলাইন গেমিংয়ে অস্ত্রের নানারকম ব্যবহার, দ্রুতগতিতে প্রতিপক্ষকে মেরে ফেলার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান, বোমা মেরে ত্রাস সৃষ্টি করে মজা দেখা ইত্যাদি সহিংস আচরণ শিশু-কিশোরদের মনে গেঁথে যাচ্ছে। পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে এক সহিংস জগৎ, যা থেকে তারা আর বের হতে পারে না।
এমনটি আমাদের সমাজেও প্রতিফলিত। এভাবেই বিশ্ব আজ অনলাইন গেমিংয়ের কালো থাবায় আক্রান্ত। দেশে সাম্প্রতিক সময়ে কিশোর অপরাধ বা কিশোর গ্যাং অপসংস্কৃতি সমাজের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণমাধ্যম সূত্রমতে, গত ১০-১১ বছরে রাজধানীতে ঘটে যাওয়া আলোচিত হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগই কিশোর অপরাধীদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের প্রতিটি গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ এবং এদের বয়স ১৫ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে।
একাধিক সমীক্ষা অনুসারে, বর্তমানে বিশ্বের ৮৭ কোটি ছেলেমেয়ে প্রতিদিন পাবজি এবং ফ্রিফায়ার খেলছে। গুগল প্লেস্টোর থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০ কোটি ডাউনলোড করা হচ্ছে। অন্য একটি অনলাইন সমীক্ষা বলছে, বাংলাদেশে প্রতিদিন এক কোটিরও বেশিবার এ গেম খেলা হচ্ছে। অন্যদিকে, বিশ্বের প্রায় ৫০ কোটি মানুষ প্রতিদিন ফ্রিফায়ার গেমটি খেলছে। বাংলাদেশে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ খেলছে। অন্য একটি জরিপে দেখা গেছে, কিশোর এবং তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের ৮.৬ শতাংশ ইন্টারনেট গেমিংয়ে আসক্ত। এর মধ্যে ৪.৮ শতাংশ কিশোর এবং ১.৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক।
অস্ট্রেলিয়ার ডায়াকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক হেলেন ইয়ং তার নিবন্ধ ‘ভায়োলেন্স অ্যান্ড ফার-রাইটস’-এ লিখেছেন, সন্ত্রাসভিত্তিক ভিডিও গেমগুলো সন্ত্রাস-হিংসাকে সাধারণীকরণের ষড়যন্ত্র। এটি মানুষের অভ্যন্তরীণ অপরাধবোধকে উস্কে দিচ্ছে। তরুণদের হত্যার বিষয়টি স্বাভাবিক হিসেবে ভাবাতে শেখানো হচ্ছে। মানুষের মধ্যে নৈতিকতা নষ্ট হচ্ছে। এমনকি রাস্তায় কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলেও এখন কেউ সামনে আসে না।
গেম নির্মাতাদের মূল লক্ষ্য হলো- ব্যবহারকারীদের মধ্যে এক ধরনের আসক্তি তৈরি করা। আসলে বিশ্বজুড়ে কয়েক মিলিয়ন কিশোর ছাত্রছাত্রী ভিডিও গেমে আসক্ত। ফলস্বরূপ সামাজিক মূল্যবোধ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি ধ্বংস হচ্ছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অক্ষম হয়ে গড়ে উঠছে। এই আসক্তি তাদের সৃজনশীল শক্তিকে দুর্বল করছে। আসক্তি কখনও কখনও আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর পথে ডেকে নিচ্ছে।
বাংলাদেশের একটি অনলাইন সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভিডিও গেমসের কারণে এ বছর প্রায় ১৭ জন আত্মহত্যা করেছে। অনলাইন গেমগুলোর আসক্তির কারণে আত্মহত্যার তালিকা দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন ভিডিও গেমের আসক্তি মাদকের চেয়ে মারাত্মক। তারা এর নাম দিয়েছিল ‘ডিজিটাল ড্রাগ’। একজন মাদকসেবী মাদক না পেলে, নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়; একইভাবে, অনলাইন গেম আসক্তরা গেমটি খেলতে না পেরে আত্মহত্যা করতেও দ্বিধা করে না।
আপনি, আপনার সন্তান, আপনার কোনো ছোট ভাই অনলাইন গেমসের অন্ধকার জগতে ডুবে যাওয়ার পূর্বেই সতর্ক হোন, সতর্ক করুন। তাদের কিশোরমনে দীনের প্রতি ভালোবাসার বীজ বপন করে দিন। আমল-আখলাক শিক্ষা দিন। নীতি-নৈতিকতা চর্চায় অভ্যস্ত করে তুলুন। সময়ের গুরুত্ব ও জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন করুন। আল্লাহ তাআলা আমাদের আগামী প্রজন্মকে হেফাজত করুন।
তরুণ আলেম লেখক, উসতাজ ও দায়ি ইলাল্লাহ।
আপনার মতামত লিখুন :