আবু জোবায়ের
মানুষ মাত্রই ভুল করে থাকে। কেউই ভুলের উর্ধ্বে নয়। এটাই সাধারণ বাস্তবতা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘প্রত্যেক বনি আদমই ভুল করে। আর তাদের মধ্যে যারা ভুলের পর তাওবাহ করে তারাই উত্তম।’ [তিরমিজি: ২৪৯৯]
তাই কেউ বড় আলেম, পীর, বক্তা ইত্যাদি হলেই যে সে নির্ভুল ও নিষ্পাপ হবে– এমনটা ভাবার সুযোগ নেই। আবার ছোট বা সাধারণ কেউ ভুল করলেই যে সে ধ্বংস হয়ে যাবে– এমনটাও সঠিক নয়। ভুল যত বড়ই হোক না কেন, অধিকাংশ ভুলেরই সমাধান সম্ভব। সমাধানের চেষ্টা করলে কখনো শতভাগ না হলেও ভুলটির বড় অংশের সমাধান অবশ্যই হয়ে যায়। একটু সময় লাগতে পারে।
সুতরাং অজ্ঞতা, উদাসীনতা, অপূর্ণতা, প্রবৃত্তি পূজা ও ভুল করা ইত্যাদি দোষে আমরা কমবেশি সবাই দোষী। কিন্তু আমরা অন্যের ভুল ধরার ক্ষেত্রে সেটি ভুলে যাই। অনেক সময় ভুলকারীর সঙ্গে এমন আচরণ করি, যা তার ভুলের চেয়েও বড় ভুলে পরিণত হয়। কখনো বা সামান্য ভুলটাকে এত বড় করে তুলি যে, সে ভালো হওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে আপন অবস্থায় থেকে যায়।
তাই কেউ কোন ভুল করলে তার সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করতে হবে, সেটিও একটি স্বতন্ত্র শেখার বিষয়। নবীজি বলেছেন– ‘আল্লাহ্ তাআলা প্রত্যেক কাজের জন্য সুন্দরতম পন্থা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।’
যদি আমরা ভুলকারীকে সদয়, আন্তরিকতা ও কৌশলের সাথে বোঝাতে পারি যে, তার কাজটা এ কারণে ভুল। তার সঠিকটা হচ্ছে এটি। ভুলের চেয়ে সঠিক কাজ করাই তো উত্তম। নিজেকে শুধরে নেওয়ায় তো সুন্দর ও উন্নত মানসিকতার পরিচয়। তাহলে অনেক ভুলকারীই ফিরে আসবে। অনেক ভুলেরই সহজে সমাধান হয়ে যাবে।
প্রাত্যহিক জীবনে আমরা ছোটখাটো যে ভুলগুলো করে থাকি– অনিচ্ছায়, অসতর্কতায় বা বুঝাবুঝির ভুলে; সেগুলোর সমাধান তাৎক্ষণিকভাবে হতে পারে। আন্তরিক ও কৌশলী হলে সেক্ষেত্রে কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু কারও ভুল যদি জটিল, পুরনো ও গভীর হয়, তাহলে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে তার সমাধানে যেতে হবে।
কারও এজাতীয় বড় ও মারাত্মক ভুলের সংশোধন করতে গেলে যে বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখে এগুতে হবে, সেগুলো হলো–
• বিশুদ্ধ নিয়ত।
• ভুলের মাত্রা নির্ণয়।
• ইনসাফ ও পক্ষপাতহীনতা।
• দলিল ভিত্তিক আলোচনা।
• স্নেহ বা শ্রদ্ধার ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা।
• জেনে ভুল আর না জেনে ভুলের মধ্যে পার্থক্যকরণ।
এরপর একজন সংশোধনকারীকে সুন্দর সমাধানের জন্যে কয়েকটি ধাপে চেষ্টা করতে হবে এবং প্রতিটি ধাপে অত্যন্ত সচেতনতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে।
প্রথম ধাপ:
কোন ভুলের সংশোধন প্রক্রিয়া শুরুর আগে তা সুনির্দিষ্ট ও সুপ্রমাণিত হওয়া আবশ্যক। ধারণা বা কানকথার ওপর ভিত্তি করে কারও ভুল ধরা উচিত নয়। এতে আপনি লজ্জিত হবেন এবং পরিস্থিতি ঘোলাটে হবে।
দ্বিতীয় ধাপ:
ভুল সংশোধনের ক্ষেত্রে ব্যালেন্স ঠিক রাখুন। তার ভুলটি আপনার দ্বারাও হতে পারত। তাই ধীরে-স্থীরে, ভেবে-চিন্তে ও ভদ্রতা-সভ্যতা বজায় রেখে সংশোধনের পথে আগান। আপনার মূল উদ্দেশ্য হবে, ভুলের সংশোধন; প্রতিশোধ গ্রহণ কিংবা শাস্তি প্রদান নয়।
তৃতীয় ধাপ:
মানুষের স্বভাবজাত কিছু ভুল থাকে, সেগুলো সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা সম্ভব নয়। কেউ জোর খাটিয়ে সে ভুল নির্মূল করতে গেলে হীতে বিপরীত হতে পারে।
হাদিসে এসেছে, নারীদেরকে পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তারা কিছুতেই পুরোপুরি সোজা হবে না। তাদের বক্রতা মেনে নিয়েই মিলেমিশে থাকতে হবে। কল্যাণের উপদেশ বাণী শুনাতে হবে। কিন্তু একেবারে সোজা করতে গেলে ভেঙে যাবে অর্থাৎ বিচ্ছেদ ঘটবে।
চতুর্থ ধাপ:
আপনি অন্যের ভুল সংশোধন করার আগে নিজের সম্মান ও অধিকার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখুন এবং যার ভুল সংশোধন করবেন, তার অবস্থান ও মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রাখুন। কেননা বয়স, সম্পর্ক ও অবস্থার পার্থক্যের কারণে আচরণে, উচ্চারণে ও পদ্ধতিতে তারতম্য আনতে হয়।
পঞ্চম ধাপ:
কারও কোন কাজকে ভুল বলার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করবেন না এবং কারও সব ভুল না ধরে কিছু ভুল দেখিয়ে দিন এবং কিছু ভুল এড়িয়ে যান। অন্যথায় ভুলকারী বিগড়ে যেতে পারে। আপনি তার শত্রুতে পরিণত হতে পারেন। হাসান বসরী (রহ.) বলেছেন, ‘কোন ভদ্রলোক কখনো কারও সব ভুল-অপরাধ ধরে না।’
ষষ্ঠ ধাপ:
কেউ একটি বিষয়ে ভুল করলে তার সব বিষয়কে সমালোচনার লক্ষ্যে পরিণত করবেন না। তাঁর কাজের ভুলটুকু চিহ্নিত করে অবশিষ্টটুকু গ্রহণ করুন। এতে সে আপনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। নিজের সংশোধনে আগ্রহী হবে। প্রয়াসী হবে। আন্তরিক হবে।
সপ্তম ধাপ:
মূর্খদের সংশোধনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন। তাদের প্রতিপক্ষ বানাবেন না। বিপরীত পক্ষের লোক মূর্খ হলে—যারা সত্য গ্রহণে প্রস্তুত না বা যাদের সত্য বোঝার যোগ্যতা নেই, বিশেষ দীনি প্রয়োজন ছাড়া তাদের এড়িয়ে চলুন। আল্লাহ বলেন, ‘রহমানের বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের জন্য অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে, তারা বলে, সালাম।’ [সূরা ফোরকান : ৬৩]
অষ্টম ধাপ:
প্রকাশ্যে মানুষের সম্মুখে কারও ভুল ধরবেন না। তাকে গোপনে ব্যক্তিগতভাবে ভুলের কথা জানান। উপদেশ দিন। ফুজাইল (রহ.) বলেন, ‘ঈমানদার লোক মানুষের দোষ গোপন রাখে ও একান্তে উপদেশ দেয়। আর পাপী লোক মানুষকে অসম্মান করে, ভর্ৎসনা করে ও প্রকাশ্যে লজ্জা দেয়।’ [জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম: ২৩৬]
নবম ধাপ:
ভুলকারীর সঙ্গে একত্রে বসে আলোচনা করুন। তাঁর প্রতি আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করুন। তার ভুলটি ধরিয়ে দিন। ভুলটির সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে তা জানান। তার ভুল সংশোধনে সহযোগিতা করুন। তাঁর ভুলের যথাযথ সঠিক বিকল্প/সমাধান দেখিয়ে দিন, যেন সে নিজেকে শুধরে নিতে পারে।
দশম ধাপ:
কারও ভুল যদি দীন, সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও দেশের জন্য ক্ষতিকারক হয় এবং ভুলকারী নিজ স্বার্থে জেনে-বুঝে ভুল করে এবং সে ভুলের একটা বলয় বা সিন্ডিকেট তৈরি হয় এবং সেখানে সমাধান প্রচেষ্টার সুযোগ না থাকে, তাহলে তার ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক করুন। তাকে বয়কট করুন। তাঁর ভুল সংশোধনে বাধ্য করুন।
আপনি শুধু অন্যের ভুল ধরিয়ে দিন। সদোপদেশ দিন। সঠিকটা দেখিয়ে দিন। ভুলের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়া আপনার দায়িত্ব নয়। আপনি তার ওপর নিজের কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিবেন না। বিতর্কে জড়াবেন না। মার্জিত আচরণ করুন। ফলাফলের জন্য আল্লাহর ওপর আস্থা ও ভরসা রাখুন।
শিক্ষার্থী: দারুল উলুম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
Like this:
Like Loading...
Leave a comment