ফ্রান্সে নবীজীর অবমাননায় মুসলমানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ চলছে। বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আরব ও মুসলিম বিশ্বে ফ্রান্সের পণ্য বয়কটের হিড়িক পড়েছে। এগুলো সবই আকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। নবীজীর অবমাননার ঘটনায় কোন মুসলমান নির্বাক, নিরুত্তাপ থাকতে পারে না।
কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় কত চমৎকারভাবেই না বলেছেন ‘রাসুলের অপমানে যদি কাঁদে না তোর মন, মুসলিম নয় মুনাফিক তুই রাসুলের দুশমন।’ আসলেই তাই, নবীজীর অবমাননায় একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে আর এটা হওয়ারই কথা। কিন্তু ফ্রান্সের এমন অসভ্য ও ধৃষ্টতামূলক আচরণের পরও মুসলিম সমাজের অনেকে এখনো নিশ্চুপ, নির্বিকার! কেনো এই নির্লিপ্ততা?
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। (সূরা আহযাব : ২১)
শুধু মৌখিকভাবে নবীজীর উপর ঈমান আনা যথেষ্ট নয়, বরং তাঁর নীতি ও সুন্নাহকে নিজেদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হয়। আল্লাহ তাআলা এজন্যই রাসূল প্রেরণ করেছেন যেন, আল্লাহর আদেশে তাঁর অনুসরণ করা হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন, “আমি রাসূলকে এই উদ্দেশ্যেই প্রেরণ করেছি যে, আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে তার আনুগত্য করা হবে।” (সূরা নিসা : ৬৪)
নিজেদের মুসলমান দাবি করা প্রত্যেকের ভেবে দেখা উচিত, দৈনন্দিন জীবনে নবীজীর পবিত্র জীবনাদর্শকে আমরা কতটুকু বাস্তবায়ন করেছি? সব বিষয়ে নবীজীর সুন্নাহ পালন আমাদের কাছে কেমন গুরুত্ব পাচ্ছে? নবীজীর রেখে যাওয়া দায়িত্ব পালনে আমরা কতটা আন্তরিক ও তৎপর?
আমরা বড় উদাসীনতার শিকার। নবীজীর সীরাত (জীবনী) অধ্যয়নে আমরা গুরুত্ব নেই বললেই চলে। আমাদের বড় একটা অংশ নবীজীর সীরাত সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। আমাদের জন্য নবীজী কী শিক্ষা, আদর্শ রেখে গিয়েছেন তা জানার ফুরসত মিলেনা অনেকেরই। যার ফলে নবীজীর ভালোবাসার দাবীদার হয়েও আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং সভ্যতা ও জীবনযাপন পদ্ধতি হয় অন্য জাতির, পাশ্চাত্যের।
আমাদের জীবন সংশয় ও স্ববিরোধিতায় পূর্ণ। আমরা নবীজীর অনুসারী হলেও আমাদের জীবনাদর্শ হচ্ছে পশ্চিমা সভ্যতা। সুন্নতে নববীর পরিবর্তে পশ্চিমা সংস্কৃতি আমাদের কাছে অনুকরণীয়। বেশভূষায় আমরা নবীজীর অনুসারী নই, পশ্চিমাদের অনুসারী। এটাই দুঃখজনক বাস্তবতা।
ইসলাম সম্পর্কে গাফলতি ও উদাসীনতা আমাদের কোমল বোধকে নীল করে ফেলেছে। আকিদা-বিশ্বাসে চির ধরিয়েছে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে ইসলামকে বিদায় জানিয়েছে। পাশ্চাত্যের নর্দমার পথে আমাদের ঠেলে দিয়েছে। নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অনেকের কাছেই এখন স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে—
১. ধর্মীয় অনুভূতির বিলুপ্তি।
২. উদর ও বস্তু পূজা।
৩. নীতি ও নৈতিকতার ধস।
৪. উদ্যমহীনতা ও আরাপ্রিয়তা।
মর্মান্তিক একটি বিষয় হচ্ছে, অসংখ্য মানুষ নবীজীর প্রতি ভালোবাসার নামে তাঁর প্রধান দুই শিক্ষা তাওহীদ ও সুন্নাহ বিরোধিতা এবং বিদআতে লিপ্ত রয়েছে। নিজেদের নবীপ্রেমকে তাঁরা কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে নিয়েছে। ইসলাম বিরোধিতা ও নবীজীর অবমাননার ঘটনা ওদেরকে প্রভাবিত করে না। বিক্ষুব্ধ করে না।
সাহাবায়ে কেরামের নবীজীর প্রতি ভালোবাসা এমন ছিল যে, নবীজীর প্রতি আসা সামান্য কষ্ট ও আঘাতও তাঁরা সহ্য করতেন না। নবীজীর জন্য ধন-সম্পদ, পরিবার ও জীবন সবকিছু উৎসর্গ করতেও তাঁরা কখনো পিছপা হননি। মুহাজির ও আনসারদের নবীপ্রেমের অসংখ্য ঘটনা আমাদের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
তাঁরা যেমন নিজেদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর সুন্নাহ ও আদর্শকে বাস্তবায়ন করতেন, তেমনি সন্তান-সন্ততি, প্রিয়জন ও আত্মীয়-স্বজনের জন্যও নবীজীর সীরাত ও সুন্নাহকেই পছন্দ করতেন, এর আলোকেই তাঁরা নিজ সন্তানকে গড়ে তুলতেন। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবকেও এর দিকে আহবান করতেন।
সুতরাং শুধুমাত্র নবীজীর প্রতি মৌখিক ভালোবাসার দাবি করলেই চলবে না; বরং তাঁর বিরুদ্ধে সকল অপপ্রচার ও অবমাননার যথোপযুক্ত জবাব দিতে হবে। ব্যক্তিগত জীবন, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নববী আদর্শের প্রতিষ্ঠা ও প্রচারের নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। সব ধরনের বিদআত ও জাহেলী রীতিনীতিকে পুরোপুরি বর্জন করতে হবে।