বৃহস্পতিবার রাত দশটায় বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে, ঘরে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে, যে যে অবস্থায় আছে সেখানে দাঁড়িয়ে এবং মসজিদে একযোগে ধ্বনিত হয়েছে তথাকথিত করোনা মুক্তির আজান। বাহরাইন, আরব আমিরাতেও আজান দেয়ার সংবাদ পাাওয়া গেছে। কোথাও কোথাও আজানের পর আল্লাহু আকবার ধ্বনির জিকির তুলে মিছিলও বের করা হয়। তাদের এই আজান ও মিছিলে সাধারণ মানুষদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই অসময়ে আজান শুনে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েন।
সরকার করোনা সামাল দিতে সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে এবং দুজনের একত্রিত চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আলেমদের পক্ষ থেকেও ঘরে নামাজ আদায়ের নির্দেশনা এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে এভাবে অসময়ে আজান দিয়ে মিছিল বের করা কতটা অযৌক্তিক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ইসলামের নির্দেশনা ভেঙে এভাবে আজান ও মিছিলের মাধ্যমে করোনা পরিস্থিতিকে আরো অবনতির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট জনেরা। এ ধরনের কাজকে বিদয়াতের বলে আখ্যায়িত করেছেন উলামায়ে কেরাম।
সূত্রে জানা যায়, ইসলামী ছাত্রসেনা নির্দেশে সারাদেশে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে মাওলানা ওবাইদুল হক নইমির সূত্রে আজানের নির্দেশ এসে বলেও উল্লেখ করেন। তবে তিনি বিষয়টি ফেসবুকে একটি ভিডিও বার্তার মাধ্যমে অস্বীকার করেন।
মহামারী থেকে রক্ষার জন্য আজান দেয়া ইসলামী শরিয়ত সম্মত কিনা সে বিষয়ে দেশ ও দেশের বাহিরের বরেণ্য কয়েকজন আলেম কুরআন ও হাদিসের আলোকে সুস্পষ্ট বক্তব্য পেশ করেছেন। কওমি ভিশনের পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হল-
• পাকিস্তানের প্রখ্যাত আলেম মুতাকাল্লিমে ইসলাম মাওলানা ইলিয়াস গুম্মান বলেন, “বিভিন্ন দুর্যোগ ও মহামারিতে একাকী অথবা দলাবদ্ধভাবে আজান দেয়ার কোনো নিয়ম নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে এবং সাহাবাদের (রাজি.) জীবনে প্রমাণিত নয়। বিভিন্ন ফিকহের কিতাবে নামাজের আজান ব্যতীত অন্যান্য যে স্থানগুলোতে আজানের কথা বলা হয়েছে, সেখানে মহামারীর কথা উল্লেখ নেই। সুতরাং এ জাতীয় আজান বিদআত; তা থেকে বিরত থাকুন।”
•• দেশের অন্যতম দীনি শিক্ষা নিকেতন জামিয়া ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগরের সিনিয়ির মুহাদ্দিস, বিশিষ্ট দায়ি, টিভি আলোচক, আল্লামা হারুন আজিজি নদভী কওমি ভিশনের একটি অনুষ্ঠানে বলেন, “গত রাত ১০ টার সময় মসজিদ থেকে যে আযানের ধ্বনি শোনা গেছে, এটা একেবারেই ভিত্তিহীন জিনিস। মহামারী দূর করার জন্য এমন কোনো নিয়ম ও পদ্ধতি কোরআন ও হাদিসে নেই। সুতরাং এটাকে মহামারী দূর করার কোনো ইবাদত মনে করা বা বানিয়ে নেয়া বিদআত হবে। কারণ শরিয়তের মধ্যে নিজেদের মনগড়া কোনো কিছুকে ইবাদত বানিয়ে নেয়া বিদআত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমার এই দীনে (নিজের পক্ষ থেকে) কোন নতুন কিছু উদ্ভাবন করল, যা তাঁর মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যানযোগ্য।” (বুখারী ও মুসলিম)
মুসলিমের অন্য এক বর্ণনায় আছে, “যে ব্যাক্তি এমন কাজ করল, যে ব্যপারে আমাদের নির্দেশ নেই, তা বর্জনীয়।” এছাড়াও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে এবং সাহাবায়ে কেরামদের (রাজি.) এর যুগে মহামারী ছিল। অথচ তাদের মাঝে এমন কোনো আমল আমরা পাই না। এমনি তাদের পরবর্তী তাবিয়ি, তবেতাবিয়িদের যুগেও এমন কোনো ঘটনার নজির ইসলামী ইতিহাসে নেই। তাই এটা পুরাই ভিত্তিহীন কাজ। আমি তাদেরকে একটি আয়াতের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি— “অতএব যারা রাসুলের আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদেরকে স্পর্শ করবে অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে।” (সুরা আন নুর: ৬৩)
তাই আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ’র বিপরীত কাজ করে মহামারী তো দূর করতে পারবই না বরং তা আরও দীর্ঘায়িত করবো। নিজেদের কল্যাণের কথা ভেবে হলেও এ জাতীয় বিদআত থেকে দূরে থাকতে হবে।”
“এছাড়াও অনেকে করোনা থেকে মুক্তি পেতে রঙ চা পান করছেন। একটি বাচ্চা জন্ম নিয়ে রঙ চা পানের আদেশ করে গেছে। বাচ্চাটি বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় জন্মগ্রহণের সংবাদ পাওয়া গেছে। আমাদের অবাক লাগে মানুষ এত বানোয়াট কথাও কী করে বিশ্বাস করে নেয়। আমাদের এসব থেকে সচেতন থাকতে হবে। ধর্মের নামে কোনো গুজব শুনছে সেটা হক্কানি উলামায়ে কেরামগণ থেকে যাচাই করে নিতে হবে।”
••• জামিয়া ইসলামিয়া লালখান বাজার মাদ্রাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মুফতি হারুন ইজহার বলেন, “এমন আজান জাস্ট মনের প্রশান্তি বা বাঁচার আকুতি। মনগড়া আবেগ দিয়ে বিদআত হয়, ইবাদত হয় না। আজ জুমার রাতে ও আগামীকাল দিনে বেশী করে দরুদের আমল করুন, এটাতে কাজ হবে।
কোনো কোনো মাজহাবের কিছু অগ্রহণযোগ্য ফিকহি কিতাবে বেশকিছু স্থানে আজানের কথা এসেছে। বিশেষতঃ শাফেঈ মাজহাবের কোনো অখ্যাত কিতাবে দেখা যায়। এটা তাদের ইস্তিহসান। হাদিসে না থাকায় তা গ্রাহ্য নয়। কেননা ইবাদতের ক্ষেত্রে ইজতিহাদ চলে না। সব কিতাব এবং সব কাতিবের সব মাসআলা সমানভাবে গ্রহণযোগ্য নয় – এটা ফতওয়ার অন্যতম মূলনীতি।
তবে কোনো মাজহাবের কোন মৌলিক গ্রহণযোগ্য গ্রন্থে মহামারীর জন্য আজানের কথা নেই। হাদিসে নবজাতকের কথা আছে। বদজীনের কথা আছে। আর আগুন ধরলে আজান নেই। তাকবির আছে। আর উপরন্তু তার জন্য সময় নির্ধারণ করে এক যোগে করার কথা তো কেউই বলেননি “
•••• বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও আলোচক মাওলানা আলী হাসান উসামা বলেন, “করোনাভাইরাস উপলক্ষে বিভিন্ন এলাকায় ঘরে ঘরে বা মসজিদে মসজিদে আজান হচ্ছে। রাসুলুল্লাহ সা., সাহাবি ও তাবেয়িদের যুগে এর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। মহামারি সে সময়ও হয়েছিল। কিন্তু তারা এসব নবোদ্ভাবিত পন্থায় তা ‘তাড়ানো’র ফিকির করেননি। এসব মহামারি মূলত শয়তানের আঘাত। তাই এর প্রতিরোধও করতে হবে সুকৌশলে, রুকইয়াহ ও সঠিক চিকিৎসার দ্বারা। হাদিস আমাদেরকে জানিয়েছে, আল্লাহ যত ব্যাধি অবতীর্ণ করেছেন, তার প্রতিষেধকও তিনি নাজিল করেছেন।
আমাদের ফিকহের গ্রন্থাদিতেও এই নবোদ্ভাবিত আজানের অনুমোদন পাওয়া যায় না। দু-এক জায়গায় পাওয়া গেলেও বিশ্লেষণের পাল্লায় তুললে তা সবিশেষ ভার বহন করে না। এছাড়াও অসংখ্য যুগশ্রেষ্ঠ ফকিহ ও মুফতি থেকে এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে। মুষ্টিমেয় কিছু ফকিহ এর অনুমোদন দেওয়ার চেষ্টা করেছেন; কিন্তু এর স্বপক্ষে তারা কোনো শক্তিশালী দলিল উপস্থাপন করতে পারেননি। অনেক আকাবির তো এটাকে প্রচলিত ভুলের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। [দ্রষ্টব্য : আগলাতুল আওয়াম, হাকিমুল উম্মাত আশরাফ আলি থানবি রহ.]
করোনা ভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করার পর থেকেই বাংলাদেশে একের পর এক গুজব সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ এতটাই গুজবপ্রিয় তা হয়ত এর আগে কেউ অনুধাবন করেনি। গুজবের ব্যাপারে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। গুজব প্রচার প্রসারে সহায়ক হব না। হাদিসে এর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে। কারো কথা শুনে কোনো যাচাই না করে প্রচার করা এটাকেও হাদিসে মিথ্যা হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। আমাদেরকে মহান আল্লাহ এসব থেকে হেফাজত করুক। আমিন।