মুহাম্মাদ গোলাম রব্বানী ইসলামাবাদী
গত ২৯শে ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষরিত তালিবান-মার্কিন চুক্তির আজ পাঁচ দিন চলছে। এর-ই মধ্যে আফগানিস্তানের পুতুল সরকারের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি চুক্তির শর্ত মোতাবেক ৫,০০০ তালিবান-বন্দীকে মুক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এরপর থেকে আফগানিস্তানে আবারও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তালিবানও তাদের হাতে বন্দী থাকা আফগান সৈন্যদের মুক্তি দিতে ও আন্তঃআফগান আলোচনা শুরু করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এর মধ্যে আফগান বাহিনীর উপর তালিবান-হামলা ও তালিবানের উপর মার্কিন বিমান-হামলার ঘটনাও ঘটেছে। বিষয়টি নিয়ে চুক্তিপক্ষীয় সবার মাঝে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায়। এসব চলার মধ্যে আকস্মিকভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তালিবানের প্রধান আলোচক মোল্লা আব্দুল গনী বারাদারের সাথে ফোনে পঁয়ত্রিশ মিনিট কথা বলেন। আলাপনে ট্রাম্প উভয়পক্ষে চুক্তি বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকার কথা বলেন। এতে সাময়িক উত্তেজনা কমে আসে বলে মনে হয়।
চুক্তি স্বাক্ষরের আগে থেকেই আশঙ্কা করা হচ্ছিলো, ভারত ও ইরান এ চুক্তি নিয়ে স্বস্তিতে নেই। ভারত ২০০১ সালে তালিবানের ক্ষমতা থেকে সরে যাবার পর থেকে হানাদার আমেরিকার সাথে মিলে আফগানিস্তানে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের উপর বিনিয়োগ করে। এতে ভারতের দু’টো প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো: প্রথমত, ভারত ভেবেছিলো, মার্কিনীরা এক সময় আফগান ত্যাগ করলেও তাদের সামরিক ঘাঁটি থেকে যাবে এবং মার্কিন প্রভাব অনির্দিষ্ট কালের জন্য অব্যাহত থাকবে। এতে করে মার্কিনীদের সাথে সখ্যতা বজায় রেখে আফগানিস্তানে ভারতের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বজায় থাকবে। সাথে-সাথে আফগানিস্তানকে তালিবানমুক্ত রাখা যাবে এবং ভারতের লাগোয়া কোন অঞ্চলে ভারতের ধারণায় কোন মৌলবাদী বা রাজনৈতিক ইসলামী শক্তির অস্তিত্ব থাকবে না। দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তানে ভারতের সবচেয়ে বড় অস্বস্তি হলো, প্রতিবেশী পাকিস্তানের প্রভাব ও তালেবানের প্রতি পাকিস্তানের সমর্থন। ভারত এটাকে নির্মূল করতে চায়। সেদিক থেকে ভারত আগাগোড়া তালিবান-মার্কিন চুক্তির বিরোধিতা করে এসেছে। ভারত মনে করছে, এ চুক্তির কারণে তার বাড়া ভাতে ছাই পড়বে। কারণ,তালিবান কখনোই ভারতকে বরদাশত করবে না। তালিবান জানে, ভারতের পূর্বাপর অভিপ্রায়। তাই, ভারত তড়িঘড়ি করে কাবুলে তার দূত পাঠিয়ে আশরাফ ঘানিকে চুক্তি অনুযায়ী তালিবান বন্দীদের মুক্তি না দিতে প্ররোচিত করে।
অন্যদিকে ইরান বেশ কিছু কারণে এ চুক্তির বিরোধী। ইরানের বিরোধিতার প্রধান কারণ হলো, ইরান মূলত একটি শিয়ারাষ্ট্র। এরা কখনও চায় না তাদের পাশে একটি সুন্নী মুসলিম সরকার চলমান থাকুক, তাও আবার খেলাফতকেন্দ্রিক। সবার স্মরণে থাকা উচিৎ, ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত সোভিয়েতবিরোধী জিহাদের সময় ইরান মুজাহিদীনের মধ্যে অনৈক্য জিইয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালায় যার নযীর তালিবানের আবির্ভাবপূর্ব সময়ে বিশ্ব দেখেছে। ১৯৯৬ সালে তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা হাতে নিলে ইরানের প্রভাব অনেকাংশে কমে যায়। কিন্তু তালিবান সরকারকে অস্বস্তিতে রাখতে ইরান ও ভারত যৌথভাবে নিহত আহমদ শাহ মাসুদের নেতৃত্বাধীন উত্তরাঞ্চলীয় জোটকে সমর্থন দিয়ে যায়। ২০০১ সালে মার্কিন হামলার সময় ইরান আমেরিকাকে সর্বাত্মক সমর্থন দেয় ও নিহত কাসেম সোলায়মানীর সর্বরাহকৃত মানচিত্র ব্যবহার করে তালিবান যোদ্ধাদের অবস্থানে আমেরিকা ব্যাপক বোমা-হামলা চালায়। এ ছাড়া, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের সুযোগ নিয়ে ইরান অন্যায়ভাবে তার সীমান্তবর্তী শুষ্ক অঞ্চলে আফগানিস্তানের বিভিন্ন নদী থেকে সব পানি নিয়ে যাচ্ছে। এখন তালিবান-মার্কিনচুক্তির মধ্য দিয়ে তালিবান ক্ষমতায় আসলে ইরান যেমন অন্যায় সুবিধা ভোগে সমর্থ হবে না, তেমনি আফগানে বাণিজ্য-আগ্রাসনও চালাতে পারবে না। ফলে, ইরান এ অঞ্চলে তার প্রভাব হারাবে।
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ভারতসহ প্রায় সব মুসলিমরাষ্ট্রকে কাতারের পক্ষ থেকে যে হাযির করা হয়েছে, তা এক কূটনৈতিক কৌশলের অপূর্ব নিদর্শন। এতে সবাইকে সাক্ষী করা হলো যেন কেউ অজ্ঞাত থাকার বাহানা তালাশ করতে না পারে। এখন তালিবান চাইছে চুক্তির বাস্তবায়ন। আমেরিকাও চাইছে, কিন্তু কারণ ও উদ্দেশ্য ভিন্ন। আফগানিস্তানের ভেতর থেকে বিভিন্ন খবরে জানা যায়, তালিবান চুক্তি অকাযর্কর হবার পরিস্থিতে করণীয় চুক্তি স্বাক্ষরের আগেই ঠিক করে রেখেছে। প্রথমত, আমেরিকা গত ২৯শে ফেব্রুয়ারী যদি চুক্তি স্বাক্ষরে গড়িমসি করতো, তেমন পরিস্থিতিতে তালিবান সুপ্রশিক্ষিত ৬০০০ তালিবান মুজাহিদকে প্রস্তুত রাখে যারা একযোগে মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালাতো। তাঁদের টার্গেট ছিলো একজন মার্কিন সৈন্যও যেন বাঁচতে পারে। এমন ভয়ংকর তথ্য মার্কিনীদের হাতে যাওয়ার পরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চুক্তি স্বাক্ষরের তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেন। এখনও তালিবান স্বাক্ষরের পরও কোন কারণে চুক্তি অকার্যকর হবার পরিস্থিতে কী করা হবে—তার প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছে। এমন মনে করার কারণ নেই যে, মুজাহিদরা চুক্তি স্বাক্ষরের পর অস্ত্র ফেলে ঘুমাচ্ছেন। এখনও তালিবান যে কোন পরিস্থিতি সামাল দিতে পূর্ণ প্রস্তুত। সেজন্য তালিবানকে আশ্বস্থ করতে ট্রাম্প সরাসরি মোল্লা বারাদারের সাথে কথা বলেছেন। কারণ, তালিবান জানে দুশমন সদা জাগ্রত। তাই তাঁরাও বিনিদ্র। এখন ভারত ও ইরান যদি মনে করে ষড়যন্ত্র করে কিছু করা যাবে, তবে সেটা হবে তাদের অপূরণীয় ভুল।