ওবাইদুল্লাহ ওবাইদ,
মিসরের হাজার বছরের ইতিহাসে সুষ্ঠ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ মুরসি গত ১৭ জুন জালিমের কারাগারে বিচারকার্য চলাকালীন মহান রবের ডাকে সাড়া দেন। আদালতের এজলাসেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করছে দেশটির সরকার। সরকারি বিবৃতি অনুযায়ী, আদালতে বিচার চলাকালে মুরসি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেখান থেকে হাসপাতালে নেওয়া হলে বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে কর্তব্যরত ডাক্তার তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তবে মুরসির দল মুসলিম ব্রাদারহুডের দাবি, আদালতে নয়, কারাগারে শহিদ হয়েছেন তিনি। তিনি দীর্ঘদিন যাবত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। কিন্তু আদালত তাঁকে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দেয়নি। দরদির নেতার মৃত্যুতে মানবাধিকার সংস্থা, জাতিসংঘ তাদের নিয়ম রক্ষার নিন্দা জানিয়েছে। এতদিন কোথায় ছিল তারা? একজন মুক্তিকামী দরদি মুসলিম নেতা বিনা চিকিৎসায় তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে হেঁটেছেন। কাঁদিয়ে যান বিশ্বের কোটি মুসলমানের হৃদয়। কান্নার ধারাক্রম বৃদ্ধি পায় অসহায় গাজাবাসীর। সারাবিশ্বের মুসলিম তাদের কেমন বন্ধু হারিয়েছে তার কিছুটা ধারণা আসে বিশিষ্ট লেখক মাওলানা ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভির হৃদয়গ্রাহী কলামেÑ
‘প্রিয় গাজা, প্রিয় গাজাবাসী, তোমাদের বন্ধু চলে গেছেন!
হামাস, কেমন বন্ধু হারিয়েছো বেশ জানো! কিন্তু এটা কি জানো যে মৃত্যুর আগে তিনি তোমাদের সাথে সম্পর্ক রাখার অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে বলতে শেষ পর্যন্ত চিরশান্ত হয়ে গেছেন! আহ! তোমাদের শুধু কাঁদলে হবে নাÑ জ্বলেও উঠতে হবে! সউদি রাজকারাগারে নিপীড়িত হকের পতাকার বাহকেরা, তোমাদের প্রিয় মুরসি জান্নাতের পথে রওনা হয়ে গেছেন! ইয়েমেনের ক্ষুধার্ত মানবতা, তোমার বন্ধু আর নেই!
প্রিয় এরদোগান, আপনার ‘বৈধ প্রেসিডেন্ট’ চলে গেছেন!
তিউনিস, মরক্কো, ইরাক, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, তোমাদের একজন ভালো বন্ধু কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন! হে ইসরাঈল, হাসো! উল্লাস করো! আমেরিকা, তুমি কী করবে? তোমার সিসিকে গোপনে অভিনন্দন জানাবে? ইহুদির দালালেরা, তোমাদের মিষ্টির দোকাগুলো শূন্য করে ফেলো! মুরসি তনয়া, কান্না বন্ধ করো! অসহনীয়! ব্রাদাহুড কাফেলা, কে কোথায় আছো জানি না, এমন বন্ধু আর কোথায় পাবে? বান্নার পরে?
তুমি হে তাহরির স্কয়ার, কেনো এতো জলদি মরে গেলে? রাবেয়া স্কয়ারের শোকে? জালিমের কবল থেকে মুক্তি পেতে হলে জানো নাÑ পাড়ি দিতে হয় হাজার রাবেয়া?’
মিসরের একমাত্র বৈধ প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর পর এভাবেই ফেসবুকে নিজেদের আবেগের কথা বলতে দেখা যায় অনেককে। আমার আফসোস হয় আমাদের ওপর। আমাদের আবেগ আছে। চোখের অশ্রু আছে। কিন্তু আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার কোনো আয়োজন নেই। পশ্চিমারা আমাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করে, ইসলাম সম্পর্কে ভুল বুঝিয়ে, জিহাদের অপব্যাখ্যা করে, অস্তিত্বের লড়াই থেকে অনেক দূরে সরিয়ে রেখেছে। হাতেগণা যে কয়জন সাহসী নেতা নিজের খ্যাতি, পুরো জীবনের অর্জন সব বিসর্জন দিয়ে ইসলামের স্বার্থে মুসলিম উম্মাহর মুক্তির প্রত্যাশায় জেগে উঠেছেন, তাদেরও সরিয়ে দিচ্ছে। সরিয়ে দেয়ার কাতারে শামিল হলেন মুহাম্মাদ মুরসিও। গাজার নির্যাতিত মা বোনদের পক্ষে কথা বলা অপরাধ ছিল। তাঁর অপরাধ ছিল ইহুদি খ্রিস্টানদের দ্বারা নিপীড়িত মুসলিমদের পক্ষে কথা বলা।
মুরসির বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃদ্ধি ও দেশের তথ্য পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। ভাবা যায়? একজন রাষ্ট্রপ্রধান নিজের দেশের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃদ্ধি করবে? নিজের দেশে তথ্য অন্য দেশে পাচার করবে? পরিস্থিতি আমাদের বলতে বাধ্য করে, অবগত করে, মিসরীয়দের গলাতে গোলামির যে তাবিজ কুফফাররা টানিয়েছে তা সহজেই নামবার নয়। তারা বুঝতেও পারছে না তাদের আসল মুক্তি কোথায়? বন্ধুকে শত্রু মনে করছে, আর শত্রুকে বন্ধু। সুহৃদ চিনতে না পারাটা মারাত্মক বিপদ। মুরসি ও মুরসির অবদানকে ভুলতে আমাদের বেশিদিন লাগবে না। বর্তমান প্রজন্ম কি হাসানুল বান্নাকে চিনে? চিনবে কী করে? তাকেও আমরা ভুলে গেছি। মাত্র ২২ বছর বয়সী হাসানুল বান্নার নেতৃত্বে মিসরের চরম এক সংকটময়ী কঠিন মুহূর্তে, মাত্র সাত বন্ধুর সমন্বিত প্রচেষ্টায় জন্ম হয় ইখওয়ানুল মুসলিমিন। মুসলমানদের অধিকার রক্ষা ও স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে কঠিন ত্যাগ স্বীকারে অভিপ্রায়ে ইখওয়ানিরা একত্রিত হয়েছিল। মুসলিম বিরোধী সন্ত্রাসীরা হাসানুল বান্নাকে সামনে অগ্রসর হতে দিল না। তাঁকে গুলি করে শহিদ করে দেয়া হয়। নির্যাতিত মুসলিমদের পক্ষে কথা বলা, মুক্তির পথ খোঁজাটাই তাঁকে শাহাতাদের পথ দেখিয়েছে। এভাবে একে একে সরিয়ে দেওয়া মুসলিম নেতাদের কাতার দিনদিন প্রলম্বিত হতে থাকে। আজও থেকে নেই। তার ধারাক্রম মুরসি পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। আজ বা কাল আমাদের অন্য কোনো নির্ভরযোগ্য নেতা পশ্চিমা টার্গেটের স্বীকার হবে না সেটার নিশ্চয়তা কী?
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, ইখওয়ানুল মুসলিম ও তার কিছু নেতার বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এটা স্বাভাবিক। বাংলাদেশে শুধু ইসলাম ধর্ম ভিত্তি দলই আছে অনেকগুলো। কোনো দল বিতর্কমুক্ত নয়। ব্যক্তি স্বার্থে দলের স্বার্থে অথবা অজ্ঞাতসারে প্রায় সকলেই আদর্শ বিসর্জন দিয়েছে।
তবে সকলেই এ রাজনীতির মাধ্যমে মুসলিমদের মুক্তি, ইসলাম প্রতিষ্ঠার আশা করেন। হাসানুল বান্না, মুরসিও তাদের একজন। এরা আমাদের ভাই, সুহৃদ, বন্ধু। পশ্চিমারা এ কারণেই তাদেরকে গুলির টার্গেট বানিয়েছে।
মুরসির দক্ষতা, খ্যাতি, ডিগ্রি কোনোটাই কম ছিল না। জীবনের সব অর্জন উপেক্ষা করে তিনি এ পথে এসছেন।
মুহাম্মাদ মুরসি মিসরের শারকিয়ার আল আদওয়াহ গ্রামে ১৯৫১ সালের ৮ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে তাঁকে লেখাপড়ার জন্য কায়রো পাঠানো হয়। ১৯৭৫ সালে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি (ইঞ্জিনিয়ারিং) সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি এক বছর মিসর সেনাবাহিনীর কেমিক্যাল যুদ্ধবিদ্যা বিভাগে চাকরি করেন। কিন্তু আবারও শিক্ষাজীবনে ফিরে যান। ১৯৭৮ সালে মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। মাস্টার্স সম্পন্ন করে তিনি উচ্চতর ডিগ্রির জন্য বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ১৯৮২ সালে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ম্যাটেরিয়াল সায়েন্সের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবনেই তিনি ইসলামী আন্দোলনের প্রতি ঝোঁকেন এবং ১৯৭৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগদান করেন। ১৯৯২ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা খোলা হলে একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, নথ্রিজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন মুহাম্মাদ মুরসি। ১৯৮৫ সালে মিসরে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত তিনি এখানেই কর্মরত ছিলেন। পাশাপাশি ১৯৮০ সাল থেকে নাসার মহাকাশযান সাটলের ইঞ্জিন প্রকল্পেও কর্মরত ছিলেন। মুহাম্মাদ মুরসি ফিলিস্তিন ভূমিকে ইসরায়েলের আগ্রাসন, মধ্যপ্রাচ্যের শাসকদের অনাচার ও মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের ভূমিকা, ইরাক ও আফগান যুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর ভূমিকার প্রকাশ্য সমালোচনা করতেন। এতে তিনি পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের আরব মিত্রদের শত্রুতে পরিণত হন।
সম্পাদক: কওমি ভিশন,
সহকারী সম্পাদক: মাসিক আল মানাহিল।